লিভারপুলের জার্সিতে গোল করার পর উদযাপনে ব্যস্ত মোহাম্মদ সালাহ। ছবি: সালাহর এক্স প্রোফাইল |
ফুটবলের মাঠে যখন বল পায়ে নিয়ে দৌড়ান, তখন মনে হয় যেন এক বজ্রপাত ছুটে যাচ্ছে। আর যখন গোল করেন, তখন স্টেডিয়ামের হাজারো দর্শকের গর্জন ছাপিয়ে যায় তার হাসিমুখের উজ্জ্বলতা। তিনি হলেন মোহাম্মদ সালাহ – মিশরের গর্ব, আফ্রিকার দূত, লিভারপুলের কিংবদন্তি।
শুরুটা একেবারে সাধারণ
মিশরের নীল ডেল্টার ছোট্ট গ্রাম নাগরিগ। চারপাশে সবুজ ক্ষেত, গরু-মহিষ, তরমুজের খেত আর কাঁচা রাস্তা। এই সাধারণ গ্রামেই জন্ম মোহাম্মদ সালাহর। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল ছিল তার একমাত্র ভালোবাসা।
সাত বছরের সালাহ রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে বল খেলতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন ব্রাজিলের রোনালদো, ফ্রান্সের জিদান বা ইতালির টট্টির মতো তারকা হওয়ার। তার প্রথম কোচ গামরি আবদ এল-হামিদ এল-সা'দানি মনে করেন—
"সে ছিল ছোটখাটো গড়নের, কিন্তু তার খেলায় ছিল জাদু। শক্তিশালী শট, গতি আর দৃঢ় সংকল্প – এগুলো তখন থেকেই তার মধ্যে ছিল।"
— Mohamed Salah (@MoSalah) August 1, 2024
পরিবারের ত্যাগ আর কঠিন যাত্রা
সালাহর ফুটবলের পথে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার পরিবার। বাবা-মা, চাচা – সবাই তার স্বপ্ন পূরণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
১৪ বছর বয়সে সালাহ যোগ দেন কায়রোভিত্তিক ক্লাব আরব কন্ট্রাক্টর্সে (আল মোকাউলুন)। তখন প্রতিদিন নাগরিগ থেকে কায়রো যেতেন অনুশীলনে – যাত্রা ছিল ভয়ংকর দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। সকাল ১০টায় বাসে চেপে রওনা দিয়ে মধ্যরাতে ফিরতেন।
প্রথমে নাগরিগ থেকে বাসিয়ুন, সেখান থেকে টান্টা, তারপর কায়রোর রামসেস বাস স্টেশন, শেষে ক্লাবের মাঠে পৌঁছানো – এক যাত্রায় তিন-চারবার বাস বদলাতে হতো। কিশোর সালাহর জন্য এই ধৈর্য ও অধ্যবসায়ই ছিল সাফল্যের ভিত্তি।
প্রথম আলো ছড়ানো আন্তর্জাতিক মঞ্চে
২০১১ সালে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে সালাহ প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে নজর কাড়েন। সেই টুর্নামেন্টে তার গতি, ড্রিবলিং এবং মনোযোগে মুগ্ধ হন সবাই। একই বছরই জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার, তখন কোচ ছিলেন হানি রামজি।
এরপর আসে ২০১৭ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব – কঙ্গোর বিপক্ষে শেষ মুহূর্তের পেনাল্টি গোলে মিশর ২৮ বছর পর বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। সে মুহূর্তে প্রায় ১২০ মিলিয়ন মিশরীয় মানুষের স্বপ্ন একসঙ্গে পূর্ণ হয়েছিল।
মোহাম্মদ সালাহ এবং লিভারপুলের সতীর্থরা।ছবিটি মোহাম্মদ সালাহ-এর X প্রোফাইল থেকে সংগৃহীত |
লিভারপুল অধ্যায়: নতুন ইতিহাসের জন্ম
২০১৭ সালে রোমা থেকে লিভারপুলে যোগ দেন সালাহ। প্রথম মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগে ৩২ গোল করে ভেঙে দেন অগণিত রেকর্ড। তখন থেকেই শুরু হয় তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার যাত্রা।
২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত সালাহর রেকর্ড:
- ম্যাচ: ৪০২
- গোল: ২৪৫
- ট্রফি: প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এফএ কাপ, লিগ কাপসহ প্রায় সব ঘরোয়া শিরোপা।
ক্লপের অধীনে তিনি শুধু একজন গোলদাতা নন, বরং দলের আক্রমণের প্রাণকেন্দ্র। ভক্তদের কাছে তিনি ‘Egyptian King’।
মানুষ সালাহ: বিনয়ী ও উদার
সাফল্যের চূড়ায় থেকেও সালাহ ভুলে যাননি কোথা থেকে এসেছেন। তার মোহাম্মদ সালাহ চ্যারিটি ফাউন্ডেশন নাগরিগ এবং আশপাশের এলাকায় অসংখ্য মানুষকে সাহায্য করছে।
তার অবদানের মধ্যে রয়েছে –
- নতুন পোস্ট অফিস নির্মাণ
- অ্যাম্বুলেন্স ইউনিট প্রতিষ্ঠা
- পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের জন্য জমি দান
- ঈদ ও রমজানে দরিদ্রদের জন্য খাবার বিতরণ
- বিধবা, এতিম ও অসহায় পরিবারের মাসিক সহায়তা
গ্রামে গেলে সাধারণ পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটেন, মানুষকে আলিঙ্গন করেন – কোন অহংকার নেই, শুধু আন্তরিকতা।
আন্তর্জাতিক সাফল্যের অপেক্ষা
লিভারপুলে সব জিতলেও, মিশরের হয়ে বড় কোনো ট্রফি এখনো জেতা হয়নি সালাহর। ২০১৭ এবং ২০২১ – দুইবার আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের ফাইনালে গিয়েও হেরে ফিরেছেন।
২০২৫ সালের ডিসেম্বরেই শুরু হবে আফ্রিকান কাপ, যা বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে। মিশরের ভক্তরা আশা করছে – এবার সালাহই এনে দেবেন দেশের জন্য বহু প্রতীক্ষিত শিরোপা।
🇪🇬👑 pic.twitter.com/PFbo1a6SUC
— Liverpool FC (@LFC) August 7, 2025
প্রেরণার উৎস
সালাহর সাফল্য শুধু মাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় – তিনি প্রমাণ করেছেন, কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা আর সততা থাকলে বড় স্বপ্ন পূরণ হয়। ইউরোপের ক্লাবগুলো এখন আরব এবং আফ্রিকান খেলোয়াড়দের প্রতি নতুন দৃষ্টিতে তাকায়, আর এর পিছনে বড় ভূমিকা সালাহর।
সাবেক মিশরীয় তারকা মিডো বলেছেন –
“সালাহ শুধু মিশরের নয়, আফ্রিকারও শ্রেষ্ঠ অ্যাম্বাসেডর। তিনি আমাদের তরুণ খেলোয়াড়দের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন।”
মোহাম্মদ সালাহর গল্প এক অনুপ্রেরণার কাহিনী। এক ছোট্ট গ্রামের ছেলে থেকে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হওয়া – তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় শেখায় যে সাফল্য আসে ধৈর্য, ত্যাগ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে।
তিনি লিভারপুলের জন্য কিংবদন্তি, মিশরের জন্য গর্ব, আর সারা বিশ্বের লাখো ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ের তারকা।