অনলাইন গেমিংয়ের ধাক্কা: ক্রিকেটারদের রোজগারে বড়সড় কোপ
ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সির স্পন্সর হিসেবে Dream11-এর হঠাৎ বিদায় শুধু একটি ছোট ঘটনা নয়, বরং ফ্যান্টাসি গেমিংয়ের বিশাল জগতে সরকারের একটি বড় সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। বিসিসিআই, যারা বরাবরই কর্পোরেট আর বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে চুম্বকের মতো কাজ করে, তারা হয়তো খুব শিগগিরই এই ধাক্কা সামলে নেবে। এশিয়া কাপ শুরুর আগেই হয়তো তারা নতুন স্পন্সরও খুঁজে ফেলবে। কিন্তু সরকারের এই 'রিয়েল মানি গেমিং' নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, কারণ এই শিল্পই ছিল ক্রিকেটজগতের প্রধান আর্থিক চালিকাশক্তি। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে ক্রিকেটারদের ওপর।

বিজ্ঞাপন এবং ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টের ক্ষেত্রে গেমিং কোম্পানিগুলো ছিল সবচেয়ে উদার। আর তাই সরকারের এই নতুন আইনের কারণে ক্রিকেটাররাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। টিভি খুললেই বা আইপিএল-এর দিকে তাকালেই দেখা যায়, প্রায় সব ভারতীয় ক্রিকেটারেরই কোনো না কোনো রিয়েল-মানি গেমিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তি ছিল। বিরাট কোহলি থেকে শুরু করে রাহুল চাহার পর্যন্ত—কেউই এর বাইরে ছিলেন না। এখন সেই সব মোটা অঙ্কের চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে।
রোহিত শর্মা, জসপ্রিত বুমরাহ, কেএল রাহুল, ঋষভ পন্ত এবং দুই পান্ডিয়া ভাই—হার্দিক ও ক্রুনাল—এঁরা সবাই Dream11-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। অন্যদিকে, শুভমান গিল, মোহাম্মদ সিরাজ, যশস্বী জয়সওয়াল, ঋতুরাজ গায়কওয়াদ, রিঙ্কু সিং এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলীর মতো তারকারাও My11 Circle-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। বিরাট কোহলি যুক্ত ছিলেন MPL-এর সঙ্গে, আর এমএস ধোনি Winzo-এর সঙ্গে। এই গেমিং ফার্মগুলো এখন তাদের সবচেয়ে বড় তারকাদের হারাতে চলেছে, আর ক্রিকেটাররাও হারাচ্ছেন তাদের আয়ের একটি বিশাল অংশ।
খেলোয়াড়দের এন্ডোর্সমেন্ট ফি একেকজনের জন্য একেকরকম। বিরাট কোহলির চুক্তি বার্ষিক প্রায় ১০-১২ কোটি টাকার ছিল বলে শোনা যায়। অন্যদিকে, রোহিত শর্মা এবং ধোনির আয় ছিল ৬-৭ কোটি টাকার আশেপাশে। আর তরুণ বা কম পরিচিত খেলোয়াড়দের জন্য এই অঙ্কটা ১ কোটি টাকার আশপাশে ঘোরাফেরা করত। সব মিলিয়ে, ভারতীয় ক্রিকেটাররা এই চুক্তি বাতিল হওয়ার কারণে বছরে প্রায় ১৫০-২০০ কোটি টাকা লোকসান গুনতে চলেছেন, কারণ নতুন আইনটি এখন সব ধরনের মাধ্যমে এই গেমগুলোর বিজ্ঞাপন ও প্রচারে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
শীর্ষ তারকাদের জন্য হয়তো এটা তাদের মোট আয়ের খুব সামান্য অংশ, মাত্র ৫-১০ শতাংশ। কিন্তু অনেক ক্রিকেটারের জন্য এর প্রভাব অনেক বেশি, ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। মোহাম্মদ সিরাজের কথাই ধরুন। সম্প্রতি তিনি তিনটি ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। My11 Circle-এর চুক্তি বাতিল হওয়ায় তার এন্ডোর্সমেন্ট আয় এক ধাক্কায় ৩৩ শতাংশ কমে গেল। একই অবস্থা ওয়াশিংটন সুন্দরেরও, যিনি Dream11-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর কিছু ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে তো অবস্থা আরও খারাপ। এই গেমিং কোম্পানিগুলোই ছিল তাদের একমাত্র আয়ের উৎস।
আইপিএল এবং পুরো শিল্পে এর প্রভাব
এই বিলের প্রথম ধাক্কাটা লেগেছে বিসিসিআই-এর জার্সি স্পনসরশিপে। কিন্তু এরপর আইপিএল এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও স্পন্সর হারাতে শুরু করবে। My11 Circle আইপিএল-এর সহযোগী স্পন্সর ছিল এবং বিসিসিআইকে বছরে ১২৫ কোটি টাকা দিত। তাদের পাঁচ বছরের চুক্তির আরও তিন বছর বাকি ছিল। এখন বিসিসিআইকে বাধ্য হয়েই নতুন সহযোগী স্পন্সর খুঁজতে হবে।
এছাড়া, কেকেআর, এলএসজি এবং এসআরএইচ-এর মতো কিছু আইপিএল দলের স্পন্সর ছিল এই গেমিং কোম্পানিগুলো, যেখান থেকে তারা বছরে ১০-২০ কোটি টাকা পেত। সেই আয়ও বন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রভাব ছোট লিগ যেমন লেজেন্ডস লিগ এবং রাজ্য পর্যায়ের টুর্নামেন্টগুলোতেও পড়বে। এসব লিগের রাজস্বের একটি বড় অংশই এভাবে হারিয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনের কারণে বিজ্ঞাপন শিল্প বছরে প্রায় ৮,০০০-১০,০০০ কোটি টাকা লোকসান করবে। এলারা ক্যাপিটালের ভাইস-প্রেসিডেন্ট করণ টাউরানি বলেন, "পুরো বিজ্ঞাপন বাজারের প্রায় ৭-৮ শতাংশই আসত এই গেমিং কোম্পানিগুলো থেকে। এখন তার ৮০ শতাংশই চলে যাবে, কারণ রিয়েল মানি গেমিং পুরো গেমিং বাজারের ৭৫-৮০ শতাংশ দখল করে আছে।" তিনি আরও যোগ করেন, "ক্রিকেটারদের এন্ডোর্সমেন্ট থেকে আয়ও ২০-২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।"

বিলটি আসলে কী নিয়ে?
বলা হচ্ছে, সরকার বহু গেমারের অভিযোগের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যারা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হারাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিলের অনুমোদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন যে এটি "আমাদের সমাজকে অনলাইন মানি গেমের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।" তবে সমালোচকরা বলছেন, যদি অনলাইন গেমিংকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে ধরা হয়, তবে মদ, জুয়া এবং ক্যাসিনোকেও একই চোখে দেখা উচিত। কেউ কেউ তো এটাও বলছেন যে এই পদক্ষেপের কারণে গেমাররা উল্টো অবৈধ বাজির বাজারের দিকে ঝুঁকতে পারে।
তবে সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল। এই বিল শুধু গেমগুলোকেই নয়, বরং টিভি, পত্রিকা বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের বিজ্ঞাপন ও প্রচারকেও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আইনটি কার্যকর করতে গেমিং লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকার একটি নতুন জাতীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করবে—অথবা কোনো বিদ্যমান সংস্থাকে দায়িত্ব দেবে—এই খাতটি তদারকি করার জন্য। তাদের কাজ হবে গেমগুলোর শ্রেণিবিভাগ করা, কোনো গেম অর্থ-সম্পর্কিত কিনা তা নির্ধারণ করা, অভিযোগ নিষ্পত্তি করা এবং নিয়মকানুন জারি করা। এই আইন ভাঙলে তিন বছর পর্যন্ত জেল এবং/অথবা ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।