![]() |
হানসি ক্রোনিয়ে: এক সময়ের উজ্জ্বল ক্রিকেটার যাঁর জীবন বিতর্কিত মোড় নিয়েছিল। ছবি এএফপি |
প্রতিশ্রুতিশীল এক তারকার জন্ম
১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে জন্ম নেন ওয়েসেল জোহানেস "হানসি" ক্রোনিয়ে। তাঁর পরিবার ছিল ধর্মভীরু এবং ক্রীড়ামুখর। শৈশব থেকেই ক্রোনিয়ে পড়াশোনা ও খেলাধুলায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল। তিনি প্রেস্টিজিয়াস 'গ্রে কলেজে' পড়াশোনা করেন, যেখানে তিনি ছিলেন হেড বয় এবং স্কুলের ক্রিকেট ও রাগবি দলের অধিনায়ক।
এই সময়ে থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলী ধরা পড়ে। ছোটবেলার বন্ধু ও পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি পেসার অ্যালান ডোনাল্ড জানান, হানসি ছিলেন “গভীর চিন্তাবিদ” এবং “জন্মগত নেতা”।
প্রোটিয়া নেতৃত্বে এক নতুন অধ্যায়
মাত্র ২১ বছর বয়সে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের অধিনায়ক হওয়া হানসি দ্রুতই জাতীয় দলে জায়গা করে নেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে আসে ১৯৯১ সালে, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের জেরে দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার পর। এই নতুন দলে হানসি ছিলেন নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধি—দৃঢ়, চতুর, আত্মবিশ্বাসী।
১৯৯৪ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অধিনায়ক হন। তাঁর অধিনায়কত্বে দল বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে তোলে। হানসির নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী, পরিশীলিত এবং প্রতিযোগিতামূলক দল। তাঁর নেতৃত্বগুণ এবং আত্মবিশ্বাসের জন্য তাঁকে অনেকেই “রাষ্ট্রনায়ক” বলেও অভিহিত করতেন।
ম্যান্ডেলার আস্থাভাজন
হানসি শুধু একজন ক্রিকেট অধিনায়ক ছিলেন না—তিনি ছিলেন দেশের জন্য একটি প্রতীক। নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যিনি তাঁকে “জাতিকে একত্রিত করতে সক্ষম নেতা” হিসেবে দেখতেন। ম্যান্ডেলার আমলে, যখন দেশ বর্ণবাদের ক্ষত থেকে মুক্ত হয়ে পুনর্গঠনের পথে হাঁটছিল, তখন ক্রোনিয়ে যেন সেই রূপান্তরের মুখ হয়ে উঠেছিলেন।
এমন এক সময়ে, যখন আফ্রিকানার সম্প্রদায় (শ্বেতাঙ্গ ডাচ বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকান) রাজনীতির মূলধারা থেকে ছিটকে যাচ্ছিল, তখন হানসি তাঁদের গর্বের প্রতীক ছিলেন।
![]() |
হানসি ক্রোনিয়ে এবং নেলসন ম্যান্ডেলা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। Getty Images |
কিন্তু এই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের পেছনে এক অন্ধকার দিকও লুকিয়ে ছিল। হানসি ছিলেন খ্যাতি ও প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে, এবং সেইসাথে ছিল অর্থের প্রতি এক অদ্ভুত মোহ। যদিও তিনি বহু স্পনসর ও এন্ডোর্সমেন্ট পেতেন, তবুও ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী—বা বলা ভালো, কৃপণ।
তাঁর সাবেক সতীর্থদের অনেকেই জানিয়েছেন, হানসি ম্যাচ-পরবর্তী পানীয় পর্যন্ত কিনতে চাইতেন না। পুমা ব্র্যান্ডের স্পনসর থেকে বিনামূল্যে পাওয়া জিনিস পর্যন্ত তিনি ছোট খেলোয়াড়দের কাছে বিক্রি করে দিতেন। তাঁর স্ত্রী বার্থাকে নিয়ে প্যারিসে রোমান্টিক ভ্রমণে গিয়ে পর্যন্ত তাঁরা রুটি-জল খেয়েই দিন কাটিয়েছিলেন, কারণ দাম দেখে তিনি খরচ করতে চাননি।
এই আর্থিক মোহই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে তাঁর পতনের প্রধান কারণ।
ফিক্সিংয়ের জালে ধরা পড়া হানসির পতনের শুরু
কিং কমিশনে স্বীকারোক্তি ও আজীবন নিষেধাজ্ঞা
হানসির স্বীকারোক্তির পর দক্ষিণ আফ্রিকায় গঠিত হয় কিং কমিশন, যেখানে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় তাঁর তিনদিনের সাক্ষ্য। তিনি স্বীকার করেন, অর্থ এবং উপহার নেওয়ার কথা, বুকমেকারদের কাছে তথ্য দেওয়া ও সতীর্থদের অনৈতিক কাজ করতে উৎসাহিত করার কথা। তবে তাঁর দাবি ছিল, কখনো কোনো ম্যাচ দল হিসেবে ‘ফিক্স’ করা হয়নি।
তবুও, এই ঘটনা তাঁকে আজীবনের জন্য ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমন তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়, তেমনি অনেকেই তাকে একটি ভুলের কারণে সর্বস্ব হারানো এক মানবিক চরিত্র হিসেবে দেখেন।
![]() |
হানসি ক্রোনিয়ে বিতর্ক এবং এর পরবর্তী ঘটনাগুলি সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে আলোড়িত করেছিল। ছবি Getty Images |
আকস্মিক মৃত্যু এবং নতুন বিতর্ক
২০০২ সালের ১ জুন, মাত্র ৩২ বছর বয়সে, একটি ছোট চার্টার্ড বিমানে করে জর্জ শহরে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন হানসি। আবহাওয়া খারাপ ছিল, পাইলটদের ভুল এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কথাও উঠে আসে। কিন্তু এত দ্রুত মৃত্যুর কারণে আবারও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মাথা চাড়া দেয়।
অনেকে মনে করেন, হানসিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, কারণ তাঁর জানা ছিল আরও অনেক নাম, আরও অনেক তথ্য। তবে এই তত্ত্বের কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ মেলেনি।
হানসি ক্রোনিয়ের ভস্ম তাঁর প্রিয় স্কুল গ্রে কলেজে রাখা হয়েছে, যেখানে তাঁর নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। তাঁর ভাই ফ্রানস একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন, যেখানে হানসিকে সহানুভূতির চোখে দেখানো হয়।
তবুও বিতর্ক থেমে নেই। কেউ বলেন, তিনি দুর্বল ছিলেন, কেউ বলেন ধূর্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়া বিজ্ঞানী টিম নোকস পর্যন্ত তাঁকে “সাইকোপ্যাথ” বলে অভিহিত করেছেন।
তবে সাংবাদিক নীল মানথর্প বলেন, “সে মন্দ ছিল না। বরং সে অত্যন্ত চতুর একজন ম্যানিপুলেটর ছিল, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন একজন মানুষ।” সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার মার্ক বুচার বলেছিলেন, “সে হয়তো প্রধান ভিলেন ছিল না, কিন্তু সে নিশ্চিতভাবেই একজন ভিলেন ছিল।”
শেষ কথা
হানসি ক্রোনিয়ের গল্পটি শুধু একজন ক্রিকেটারের নয়। এটি একজন মানুষের গল্প—যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভুল করেছেন, চেষ্টা করেছেন সংশোধনের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুযোগ পাননি। একজন নায়ক যিনি বিশ্বাস ভেঙেছেন, আবার একজন বিশ্বাসভঙ্গকারী যিনি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হতে চেয়েছিলেন।
ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন কিছু নাম থেকে যায়, যাদের আমরা পুরোপুরি ভালোবাসতেও পারি না, ঘৃণাও করতে পারি না—হানসি ক্রোনিয়ে ঠিক তেমনই এক নাম। তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, খেলাধুলার মঞ্চে নৈতিকতা, প্রলোভন ও মানবিক দুর্বলতা—সবই একসাথে চলে।