টটেনহ্যাম ছাড়ছেন সন, ক্লাবে তাঁর ১০ বছরের যাত্রার অবসান।

টটেনহ্যাম হটস্পারের দক্ষিণ কোরিয়ান অধিনায়ক হিউং-মিন সন
টটেনহ্যাম হটস্পারের হিউং-মিন সন –ছবি রয়টার্স

একটি ক্লাব। একটি নাম্বার ৭ জার্সি। একটি স্বপ্ন। আর একটি দশক দীর্ঘ সম্পর্কের সমাপ্তি। টটেনহ্যাম হটস্পারের অধিনায়ক ও দক্ষিণ কোরিয়ান তারকা সন হিউং-মিন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ক্লাব ছেড়ে যাচ্ছেন।

এই ঘোষণা যেন উত্তর লন্ডনের বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে একধরনের শূন্যতা। যারা গত দশ বছর ধরে সনকে অনুসরণ করেছেন, জানেন এই সিদ্ধান্ত কতটা আবেগময়, কতটা ঐতিহাসিক।

যেভাবে শুরু

২০১৫ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে সন যখন বায়ার লেভারকুসেন থেকে টটেনহ্যামে যোগ দেন, তখন তিনি ছিলেন প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে দামি এশিয়ান ফুটবলার। ২.২৫ কোটি পাউন্ডের সেই চুক্তিটি আজ ইতিহাস। তখন কেউ ভাবেননি যে এই লাজুক ছেলেটিই একদিন টটেনহ্যামের অধিনায়ক হবেন, ক্লাব কিংবদন্তি হবেন।

কিন্তু সন শুধু খেলোয়াড় ছিলেন না—তিনি ছিলেন টটেনহ্যামের আত্মা। ৪৫৪টি ম্যাচে ১৭৩টি গোল, এবং অসংখ্য মুহূর্ত—যা আজও স্পার্স ভক্তদের মনে গেঁথে আছে।

২০১৯ সালে বার্নলির বিপক্ষে তার একক গোল—নিজের পেনাল্টি বক্স থেকে দৌড়ে প্রতিপক্ষের গোলে বল পাঠানো—যা তাকে এনে দেয় ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড। সেবার সবাই বলেছিল, “এই খেলোয়াড় স্বপ্ন দেখায়।” আর সেটাই সনের মূল শক্তি—সে মাঠে এবং মাঠের বাইরে মানুষের হৃদয় জয় করে নিতে জানে।

শুধু মাঠেই নয়, মানুষের মনেও সন

সনের মানবিক দিকটিও টটেনহ্যাম ভক্তদের কাছে তার বিশেষত্বের একটি বড় কারণ। সতীর্থদের জন্য ব্যক্তিগত উপহার, দলের সঙ্গে কোরিয়ান বারবিকিউতে বিল পরিশোধ, বা ভক্তদের উদ্দেশে জার্সি ছুঁড়ে দেওয়া—এসব মুহূর্ত তাকে করেছে ‘মিস্টার নাইস গাই’।

একবার দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রি-সিজন সফরে, টটেনহ্যাম দল যখন বিমানবন্দরে পৌঁছায়, তখন সন হঠাৎ ‘সিওলে স্বাগতম’ প্ল্যাকার্ড হাতে হাজির হন সতীর্থদের অভ্যর্থনা জানাতে। সেই মুহূর্তে শত শত ফ্যানের চিৎকারে ইঞ্চিওন বিমানবন্দর যেন কনসার্ট ভেন্যুতে রূপ নেয়।

সনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রাক্তন টটেনহ্যাম সতীর্থ কেভিন উইমার বলেন, “আমি মনে করি না টটেনহ্যামে আমরা আর কোনো সনকে দেখতে পাব।” উইমারের মতে, “ওর জনপ্রিয়তা এমন, যেন রকস্টারের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা।” এমনকি কাইল ওয়াকারও একবার বলেছিলেন, “রুনি, ল্যাম্পার্ড, বেকহ্যামের সঙ্গে আমি যা দেখেছি, সন তার চেয়েও উপরে।”

সনের উপস্থিতি দক্ষিণ কোরিয়ায়
সনের উপস্থিতি দক্ষিণ কোরিয়ায় – যেমন ২০২২ সালের জুলাইয়ে সিওলে স্পার্স ও টিম কে লিগের মধ্যকার প্রদর্শনী ম্যাচে – সবসময়ই উচ্ছ্বসিত দর্শকদের ভিড় টেনে আনে।ছবি Getty Images
দক্ষিণ কোরিয়ায় সনের গ্রহণযোগ্যতা শুধু ক্রীড়াজগতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি সেখানে বিটিএস কিংবা ব্ল্যাকপিঙ্কের মতো কেপপ তারকাদের মতোই জনপ্রিয়। দেশের মানুষ তাকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করে। সেওল শহরের বাসে তার ছবি, বিজ্ঞাপন বিলবোর্ডে হাস্যোজ্জ্বল মুখ—সন যেন কেবল একজন ফুটবলার নন, পুরো একটি জাতির অহংকার। 

সাফল্যের পাশে ছিল কষ্টের মুহূর্তও। ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে লিভারপুলের কাছে হার, ২০২১ সালে ইএফএল কাপ ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে পরাজয়। কিংবা আন্দ্রে গোমেসের গোড়ালির সেই মর্মান্তিক মুহূর্ত, যা দেখে সন নিজেই কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন।

তবুও, তার পেশাদারিত্ব কখনও প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। ক্লাবের জন্য, সতীর্থদের জন্য এবং ভক্তদের জন্য তার ভালোবাসা আজও উদাহরণ।

প্রাপ্তির তালিকা বিশাল

সনের অর্জনের তালিকা চোখ ধাঁধানো—প্রিমিয়ার লিগ গোল্ডেন বুট (২০২১-২২), চারবার প্লেয়ার অফ দ্য মান্থ, তিনবার ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়, ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো তার আসল পরিচয় নয়।

সন হচ্ছেন সেই খেলোয়াড়, যিনি মাঠে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী, মাঠের বাইরে তেমন বন্ধুবৎসল। তিনি এক জেনারেশনের আইডল, এক জাতির মুখ।

টটেনহ্যামের সন হিউং-মিন ইউরোপা লিগ ২০২৫ এর ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে খেলার সময়
২০২৫ সালে বিলবাওয়ে অনুষ্ঠিত ইউরোপা লিগ ফাইনালে টটেনহ্যাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে পরাজিত করলে সন অবশেষে একটি বড় ট্রফি নিজের হাতে তুলে নিতে সক্ষম হন। ছবি রয়টার্স

সনের এই বিদায় কেবল একজন খেলোয়াড়ের ক্লাব ছেড়ে যাওয়া নয়; এটি একটি যুগের অবসান। টটেনহ্যামে তার ১০ বছরের যাত্রা কেবল পরিসংখ্যান নয়, অনুভূতির গল্প। মাঠে তার শেষ গোল, ভক্তের উদ্দেশে শেষ হাত নাড়ানো, সতীর্থদের সঙ্গে শেষ আলিঙ্গন—সবই ইতিহাস হয়ে থাকবে।

তবে শেষ মানেই শেষ নয়। সন হয়তো টটেনহ্যামের জার্সি আর পরবেন না, কিন্তু উত্তর লন্ডনের প্রতিটি প্রান্তে, প্রতিটি গ্যালারিতে, তার গল্প, তার গোল, তার হাসি—সবই থাকবে।

তিনি ছিলেন, আছেন, এবং থাকবেন—স্পার্সের সন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন